১৮ বছর 'নিখোঁজ' থাকার পর মালয়েশিয়া থেকে দেশে ফিরে দেখেন বাবা-মা নেই, স্ত্রী অন্যের সংসারে
দালালের মাধ্যমে মালয়েশিয়া গিয়েছিলেন নরসিংদীর চরদিঘলদী ইউনিয়নের জিতরামপুর গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম। প্রথমদিকে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ থাকলেও একসময় তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ দেড় যুগ ধরে নিখোঁজ থাকার পর পরিবার ধরে নেয়, জাহাঙ্গীর আর বেঁচে নেই। অবশেষে তিনি দেশে ফিরেছেন গত ৭ নভেম্বর। তবে ফিরে পেয়েছেন ভাঙাচোরা বাস্তবতা, বাবা–মা নেই, স্ত্রীও অন্যের সংসারে।
৬৬ বছর বয়সী জাহাঙ্গীর আলম মৃত গিয়াস উদ্দিনের ছেলে। পেশায় তিনি ছিলেন জেলে। মেঘনার বুকে মাছ ধরে চলত তার সংসার। বাবা–মা, স্ত্রী এবং চার সন্তানকে রেখে দালালের প্রলোভনে অবৈধ পথে মালয়েশিয়া পাড়ি জমান তিনি।
নরসিংদী সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আসমা জাহান সরকার জানান, গত ২১ অক্টোবর মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে যোগাযোগ করেন কাউন্সেলর (লেবার) সৈয়দ শরীফুল ইসলাম। তিনি জানান, কোনো ডকুমেন্ট ছাড়াই এক বাংলাদেশি ক্যাম্পে আটক রয়েছেন। অসুস্থতার কারণে তিনি কথা বলতে পারেন না, ফলে পরিচয়ও অজানা।
হাইকমিশন ওই ব্যক্তির ছবি সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করলে অনেকেই নিজেদের স্বজন দাবি করলেও কেউই প্রমাণ দিতে পারেননি। পোস্টে নরসিংদীর এক ব্যক্তি মন্তব্য করে জানান, লোকটি চরদিঘলদী ইউনিয়নের বাসিন্দা হতে পারেন। এরপর ইউএনও তদন্ত শুরু করেন। স্থানীয় প্রতিনিধিদের সহায়তায় খুঁজে পাওয়া যায় জাহাঙ্গীরের পরিবারকে, এবং নিশ্চিত হওয়া যায় আটক ব্যক্তি নিখোঁজ জাহাঙ্গীর আলমই।
পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতা বিবেচনায় ইউএনও প্রয়োজনীয় সব কাগজ সংগ্রহ করে দ্রুত হাইকমিশনে পাঠান এবং সরকারি ব্যয়ে দেশে পাঠানোর অনুরোধ জানান। দীর্ঘ ১৮ বছর পর গত ৭ নভেম্বর দেশে ফেরেন জাহাঙ্গীর। পরিবার তাকে বিমানবন্দর থেকে বাড়ি নিয়ে আসে।
দেশে ফিরে দেখেন, বাবা-মা মারা গেছেন, স্ত্রী নতুন পরিবারে। মালয়েশিয়ায় কারাবন্দী কঠিন জীবন আর অসুস্থতায় জাহাঙ্গীর এখন বাকশক্তিও হারিয়েছেন। কখনো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন, কখনো আবার অঝোরে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
বৃহস্পতিবার উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে ২০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা ও প্রয়োজনীয় উপহার দেওয়া হয়। উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয় তার জন্য প্রতিবন্ধী ভাতা অনুমোদনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। বর্তমানে তিনি নরসিংদী জেলা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
জাহাঙ্গীরের বড় ছেলে আমান উল্লাহ বলেন, “বাবাকে ফিরে পেয়েছি, এটাই আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় পাওয়া। আমরা সবাই খুব খুশি।”
চরদিঘলদী ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোসা. সেলিনা আক্তার জানান, ইউনিয়ন পরিষদ থেকেও আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, “দালালের ফাঁদে পড়ে কেউ যেন জাহাঙ্গীরের মতো পথে না যায় এই বিষয়ে আমরা সচেতনতা বাড়াব।”
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, “দালালের প্রলোভনে অবৈধ পথে বিদেশে না যাওয়ার জন্য সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। একটি ভুল সিদ্ধান্ত যেন পুরো পরিবারের সারা জীবনের কান্না না হয়।”
